Type Here to Get Search Results !

উৎকণ্ঠায় মা-বাবা ও স্বজন, চারদিকে কান্নার রোল

রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র আরিয়ানের মা আঁখি আক্তারের আহাজারিতে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট এলাকা ভারি হয়ে উঠেছিল। ১০ বছর বয়সী আরিয়ান প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালের চতুর্থ তলার নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন। তার শরীরের ৬০ শতাংশ পুড়ে গেছে। আঁখি আক্তারের সঙ্গে থাকা এক আত্মীয় জানান, দুপুরে আহত হওয়ার পর তাকে অ্যাম্বুলেন্সে করে বার্ন ইনস্টিটিউটে আনা হয়। তার অবস্থা ভালো নয়। শুধু জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট নয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ এবং উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতাল ঘুরে স্বজনদের এমন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা গেছে। গত সোমবার বিমানটি বিধ্বস্ত হলে দুপুর দেড়টার পর থেকে দগ্ধ ও আহত ব্যক্তিদের নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স আসতে থাকে এসব হাসপাতালে। তাদের সবার হাত-পা, মুখ, বুক, পিঠ ঝলসে গেছে। কেউ কেউ গুরুতর দগ্ধ হয়েছে। দগ্ধ অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীর শ্বাসনালি পুড়ে গেছে। অন্তত ৫০ জনের অবস্থা সংকটাপন্ন। তাদের একজন বাপ্পি সরকার, মাইলস্টোনের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। বার্ন ইনস্টিটিউটের চতুর্থ তলার আইসিইউতে থাকা বাপ্পির শরীরের ৬৫ শতাংশ পুড়ে গেছে। বাপ্পির বাবা শাহীন সরকার উদ্বিগ্ন হয়ে ছোটাছুটি করছিলেন। কখনও সন্তানের অবস্থার খোঁজ নিতে চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলছেন, কখনও রক্তের খোঁজে ছুটছিলেন। শাহীন সরকার জানান, তাঁর ছেলে শ্রেণিকক্ষে বসে ছিল। দুপুরেই তাকে হাসপাতালে আনা হয়। তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত পুড়ে গেছে। সময় যত যাচ্ছে, তার শ্বাসকষ্ট বাড়ছে। শুধু আরিয়ান ও বাপ্পি নয়, অনেকের মা-বাবা, চাচা, মামা, দাদা-নানারাও উদ্বিগ্ন হয়ে কাটাচ্ছেন শঙ্কার প্রহর। জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে আনার পর দগ্ধদের মধ্যে দুজন মারা গেছে। তাদের মধ্যে নাহিদ হাসান নামে এক শিক্ষার্থী রয়েছে। সেখানেই পাওয়া গেল তার দাদা মোহাম্মদ মোসলেম উদ্দিনকে। নাতিকে হারিয়ে বার্ন ইনস্টিটিউটের সামনে রাস্তায় বসে আহাজারি করছিলেন তিনি। তিনি বলেন, ‘আমার নাতি নাহিদ হাসান তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ত। বাসা থেকে হেঁটে আসতে ৫-৭ মিনিট লাগে। আমার কলিজার টুকরা নাই। না করছি, বড় স্কুল কলেজে পড়াইস না। আজরাইলে নিছেরে, আমার কলিজারে আজরাইলে নিছে।’ মাইলস্টোন স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র উক্যছাইন মারমাকে সপ্তম তলার আইসিইউতে ভর্তি করা হয়েছে। তার শরীরের ৯৫ শতাংশ পুড়ে গেছে। একই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন নাজিয়া, নাফিজ ও জুনায়েদের জন্য আহাজারি করছিলেন তাদের মামা রুমিন আহমেদ। এই শিক্ষার্থীরা হাসপাতালের বিভিন্ন তলায় ভর্তি আছে। মাইলস্টোনের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী তাহসিনা ৩৫ শতাংশ পোড়া শরীর নিয়ে ভর্তি পঞ্চম তলার ৫২০ নম্বর ওয়ার্ডে। তার বাবা নাজমুল হককে উদ্বিগ্ন মুখে ছোটাছুটি করছেন। তৃতীয় শ্রেণির ছোট ছোট তিনটি মুখ, যাদের প্রতিদিনের জীবনে ছিল খেলা, পড়াশোনা আর স্বপ্ন– সেই ওয়াকিয়া আহমেদ নিধি, আফিয়া উম্মে সায়মা, আর শামীমা। আজ তারা নিখোঁজ। হাসপাতালের পর হাসপাতাল, বার্ন ইউনিট থেকে মর্গ– স্বজনরা খুঁজছেন, খুঁজেই চলেছেন। নিধির বাবা ফারুক হোসেন আর ভাই আসাদ এখন পাগলপ্রায়। উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে কথা হয় তাদের সঙ্গে। বললেন, ‘ও তো স্কুলে গিয়েছিল, ফিরে আসেনি, কেউ কিছু জানে না। হাসপাতাল ঘুরছি, কেউ কিছু বলতে পারছে না।’ নিধির বড় ভাই আসাদ বলেন, ‘আমরা দুপুর থেকে খুঁজছি তাকে। খবর পেয়েছিলাম উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজে ভর্তি আছে, সব রোগী খুঁজেও আমার বোনকে পাইনি।’ আরেক শিক্ষার্থীর বাবা মজিবুর রহমান বলেন, ‘আমি অফিসে ছিলাম, খবর পেয়েই ছুটে এসেছি। মেয়ের খোঁজ পাই না। কেউ বলে বার্ন ইউনিটে, কেউ বলে ও এখানে ছিল না। আমার মেয়েটা কোথায় গেল?’ উত্তরার দিয়াবাড়ী নিবাসী সুকুমার ঘোষ ও পপি ঘোষের মেয়ে শ্রেয়া ঘোষ তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী। বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় তার শরীরের ৮ শতাংশ পুড়েছে। বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন শ্রেয়া ঘোষের মা পপি ঘোষ জানান, বিমান বিধ্বস্তের একটু আগে স্কুল ছুটি হয়েছিল। তখন স্কুলের গেটের বাইরে অন্য অভিভাবকদের মতো তিনিও অপেক্ষা করছিলেন মেয়ের জন্য। এ সময় বিকট শব্দে বিমান বিধ্বস্ত হয়। এক পর্যায়ে আগুনের লেলিহান শিখা দেখে সব অভিভাবক দৌড়ে ভেতরে গিয়ে ভয়ংকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন। আগুনের মধ্যেই শিক্ষার্থীরা দৌড়ে বেরিয়ে আসে। পপি ঘোষ আরো জানান, তিনি তখন মেয়ের জন্য পাগলের মতো ছোটাছুটি করছিলেন। এক পর্যায়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে উদ্ধার অভিযান শুরু করেন। এ সময় মেয়েকে উদ্ধারের আকুতি জানিয়ে তিনি ফায়ার সার্ভিস কর্মীর পা পর্যন্ত জড়িয়ে ধরেছিলেন। কিছু সময় পর তার মেয়ে দৌড়ে বেরিয়ে আসে। তবে তার শরীরের বেশ কিছু অংশ পুড়ে গেছে। শ্রেয়া ঘোষের চাচা সৌরভ ঘোষ জানান, স্কুলের একটি ভবনের সামনে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। ভবনটি দোতলা। সেখানে পাঠদান করা হয়। ভবনটির নাম প্রজেক্ট-২। ওই ভবনে দুটি তলা মিলিয়ে মোট ১৬টি ক্লাসরুম আছে। আর চারটি শিক্ষকদের রুম। প্রাথমিকের প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির ক্লাস হতো এই ভবনে। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির শ্রেণিকক্ষের সামনে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়েছে। তবে ভবনটিতে ছুটির পর ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা কোচিং করত। তিনি আরও বলেন, তার ভাতিজি শ্রেয়া ঘোষের ছুটি হয়ে গেলেও তখনও বের হয়নি তারা। পরে শ্রেণি শিক্ষকের সহায়তায় শ্রেয়া ঘোষসহ অন্য শিক্ষার্থীরা বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়। শামীমা নামে তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীটির মা নেই, নেই বাবাও। ছোট্ট মেয়েটির পুরো পৃথিবী ছিল একজন– তার দাদা হারুন। ঘটনার পর হাসপাতালে এসে এক কোণে বসে কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ‘মা-বাবাহারা নাতনিটা আমার, আমি ছাড়া কেউ নাই তার। দুপুরে খাবার দিয়ে বলছিলাম– দাদা, টিফিনে খেয়ে নিও। ও এখন কোথায় গেল?’ প্রবীণ মানুষটি আর কথা বলতে পারেন না। শুধু দুই হাতে মুখ ঢেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। একইভাবে আরেক শিক্ষার্থী আফিয়া উম্মে সায়মার খোঁজ মেলেনি এখনও। তার খালাতো বোন মুন্নী আর মুক্তি বলেন, ‘আমাদের আদরের বোনটাকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। সায়মার বই, খাতা সব পড়ে আছে ক্লাসে, কিন্তু ওকে কেউ দেখেনি। কেউ জানে না কোথায় গেল। বার্ন ইউনিটেও খোঁজ করেছি, এখানে নেই, মর্গেও খুঁজেছি।’ মুন্নী জানান, তাদের পরিবার পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। সায়মা ছিল পরিবারের একমাত্র শিশু– তার অনুপস্থিতিতে যেন সময় থেমে গেছে। এদিকে সন্তানকে আনতে গিয়ে মা লামিয়া আক্তারও নিখোঁজ রয়েছেন বলে জানান স্বজনরা। উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ট্র্যাজেডির ঘটনায় সোমবার রাত পর্যন্ত জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ৪৬ জন ভর্তি ছিলেন। তাদের মধ্যে ৪০ জন শিক্ষার্থী। যারা তৃতীয় থেকে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী। আর বাকি ছয়জন মাইলস্টোনের শিক্ষক। উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন ১৬০ জন, এখনও ভর্তি আছেন ২৩ জন। আমারবাঙলা/জিজি

from Amarbangla sodesh Feed https://ift.tt/QMrAlNs

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad

Hollywood Movies